সোনারগাঁয়ে সুলতান আমলের পুরনো মসজিদ

সোনারগাঁয়ে সুলতান আমলের পুরনো মসজিদ

ইয়াকুব হোসেন সোনারগাঁও:

নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও পৌরসভার  শাহী মসজিদের ইতিহাস সংবলিত একটি সাইনবোর্ড প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর টাঙিয়ে রেখেছে। তাতে লেখা আছে, মোগল আমলে ঢাকায় রাজধানী স্থাপনের আগে সোনারগাঁয়ে বার ভূঁইয়া প্রধান ঈশা খাঁ, মুসা খাঁ ও এর আগের স্বাধীন সুলতানদের রাজধানী ছিল। রাজধানী ও রাজসভার জন্য মনোরম ইমারত ছাড়াও মুসলিম শাসকেরা এখানে মসজিদ, খানকা ও সমাধি নির্মাণ করেন। তার মধ্যে এ মসজিদ অন্যতম।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বরাতে জানা যায়, সরকার ১৯৭৫ সাল থেকে এ মসজিদের ঐতিহ্য রক্ষণাবেক্ষণসহ অন্যান্য সার্বিক বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। ইতিহাস বিকৃত না হওয়ার জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদের ইতিহাস সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রেখেছে।

সংরক্ষণের অভাবে সোনারগাঁয়ের মুসলিম ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন গোয়ালদী শাহী মসজিদের একটি পিলার ও ভেতরের বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়ছে। খসে পড়ছে ফুল, লতাপাতা আঁকা বিভিন্ন নকশা ও আরবি লিপির অলংকরণ। সুলতানি আমলের এ মসজিদটি সংরক্ষণের জন্য স্থানীয়রা দাবি জানিয়েছেন।

পাঁচশ’ বছরের পুরনো মসজিদটি চূড়ান্তভাবে সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে আবেদন করা হলেও সর্বশেষ কী অবস্থায় রয়েছে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় পানাম সিটির সাইড ম্যানেজার জাহাঙ্গির আলম ভূঁইয়া। তিনি বলেন, মসজিদটি সংরক্ষণের জন্য আবেদন করেছি। এ অর্থবছরে কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। আশা করছি খুব দ্রত সংস্কার কাজ শুরু করা হবে।

প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা, আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ বাংলার মসনদে আহরণের পর ১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দের কোনো এক সময়ে আলা উদ্দিন হুসাইন শাহের একান্ত অনুগত মোল্লা হিজবর আকবর খাঁ এ মসজিদটি নির্মাণ করেন।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মোগরাপাড়া চৌরাস্তা থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার পূর্বে সোনারগাঁ পৌরসভার ছায়া সুনিবিড় গোয়ালদী গ্রামে এ শাহী মসজিদটির অবস্থান।

কথিত আছে, সুদীর্ঘ বছর ঘন বনজঙ্গলে আবৃত ছিল এ মসজিদটি। পরে স্থানীয় বাসিন্দারা মসজিদটি আবিস্কার করলে একে স্থানীয় ভাবে গায়েবি মসজিদ নামে অভিহিত করা হয়। এক গম্বুজবিশিষ্ট বর্গাকৃতির এ মসজিদটির প্রতিটি দেয়াল প্রায় তিন মিটার চওড়া এবং এর চার কোনায় চারটি খিলান তৈরি করা হয়েছে। দ্বিকেন্দ্রিক রীতিতে মসজিদটির নির্মাণ শৈলীতে তৎকালীন সুলতানি আমলের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কালো রঙের কষ্টিপাথরে খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে এর মেহরাব। মেহরাবের গায়ে ফুল লতাপাতা আঁকা বিভিন্ন নকশা এবং আরবি লিপির অলংকরণ অত্যন্ত আকর্ষণীয়।

১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের আগে অধ্যাপক দানী মসজিদটি দেখতে এসেছিলেন। তখন তিনি মসজিদটি টিলা আকারের মতো দেখেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। প্রন্থকার আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া লিখেছেন, ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে মসজিদটিকে প্রথম যখন তিনি দেখেছেন, তখন সেখানে তেমন কোনো উঁচু ভূমি দেখেননি।

এ প্রাচীন মসজিদটি ১৫ শাবান ৯২৫ হিজরিতে নির্মিত। সোনারগাঁ ইতিহাস গ্রন্থের ১৯৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে- ১২ আগস্ট ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে সুলতান হোসাইন শাহের শাসনামলে মোল্লা হিজবর আকবর খান গোয়ালদী মসজিদটি নির্মাণ করেন।

পঞ্চদশ শতকের মসলিনখ্যাত বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁ। সোনারগাঁয়ের অসংখ্য পুরাকীর্তির মধ্যে গোয়ালদীর শৈল্পিক মসজিদটি অন্যতম। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সেন ও পালবংশের শাসনের সমাপ্তি ঘটলে মুসলিম সুলতানরা রাজ্য শাসন করেছেন। যখনই মুসলিম শাসকরা কোনো প্রদেশ বা অঞ্চল জয় করেছেন, তখন সেখানে শৈল্পিক মসজিদ নির্মাণ করেছেন।

বাংলাদেশে সুলতানি আমলের বেশকিছু শাহী মসজিদ এখনও কালের সাক্ষী হয়ে এখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। এসব শৈল্পিক মসজিদের মধ্যে গোয়ালদী মসজিদ অন্যতম।

বাংলার মুসলিম সুলতানদের অন্যতম রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। এই সোনারগাঁয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নানা ইতিহাস। প্রাচীন পানাম নগরীর অদূরে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে গোয়ালদীতে সুলতানি আমলের মসজিদ এটি।

 

আপনি আরও পড়তে পারেন